শনিবার ১৮ মে ২০২৪
Online Edition

আইনের শাসনের অবনতি দায় কার? 

মো. তোফাজ্জল বিন আমীন 

আইনের শাসন একটি ধারণা মাত্র। এর মূল কথা হচ্ছে রাষ্ট্র কোন ব্যক্তি নয়, আইন দ্বারা পরিচালিত হবে। দল-মত নির্বিশেষে সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আইনের চোখে সমান। অর্থাৎ সবকিছুর উপরে আইনের প্রাধান্যের স্কীকৃতিকে আইনের শাসন বোঝায়। আইনের শাসন সূর্য থেকে আসে না। ভিন দেশ থেকে ধার করেও আনা যায় না। রাষ্ট্রকেই তা প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, সরকারী দল, বিরোধী দল, ভিন্নমত পোষণকারী ছোটো-বড়ো নির্বিশেষে সবাই আইনের চোখে সমান। কেউ আইন ভঙ্গ করলে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে-এটাই আইনের শাসনের বিধান। আইনের শাসন না থাকলে গণতন্ত্র কার্যকর হয় না। টেকসই উন্নয়ন হয় না। আইনের শাসনে ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী সরকার চলবে না, সরকার চলবে পূর্বনির্ধারিত ও অনুমোদিত আইন দ্বারা। সংবিধানের প্রস্তাবনায়ও বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক নাগরিক আইন অনুসরণ করবে। দেশের নাগরিকবৃন্দ আইন মান্য করবে। সরকার আইন মান্য করবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আইনের শাসনের ব্যত্যয় চোখ মেলে তাকালেই দেখা যায়। তবে যারাই ক্ষমতায় থাকে তাদের কাছ থেকে আইনের শাসনের ব্যাখ্যা শুনলে মনে হবে (ডব্লিউজেপি) এর প্রকাশিত প্রতিবেদন উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত কিংবা মিথ্যা। আইনের শাসনের নমুনা কেমন তা বুঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ আইনের শাসনের প্রতিচ্ছবি মানুষের আচরণের মধ্যেই ফুটে উঠে। যে দেশের একজন নাগরিক মনের দুঃখে নিজের বাইকে নিজে আগুন ধরিয়ে দেয়, কৃষক ধানের ন্যাযমূল্য না পেয়ে নিজের পাকা ধানের জমিতে আগুন লাগিয়ে দেয় সে দেশের আইনের শাসনের সূচক বোঝার জন্য বিদেশি সংস্থার প্রতিবেদনের প্রয়োজন পড়ে না; চোখ মেলে তাকালেই অনেক কিছু দেখা যায়।

গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌমত্বের অধিকারী হলেও শাসন ব্যবস্থায় জনগণের অধিকার নাও থাকতে পারে। কারণ ক্ষমতায় টিকে থাকা কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জনগণের ভোটাধিকারের প্রয়োজন পড়ে না। সম্প্রতি বিবিসি ২০০৮ সালের নির্বাচনে যারা প্রথম ভোট দিয়েছেন তাদের সাক্ষাতের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদন মারফত জানতে পারলাম দেশের অধিকাংশ তরুণ ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আর কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি কিংবা ভোট দিতে যায়নি। এটা কি আইনের শাসনের ব্যত্যয় নয়? আইনের শাসনের সূচকের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম। কিন্তু গণতন্ত্রহীনতার সূচক তলানীতে কেন? ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতেছে। কিন্তু ভোটাধিকার উধাও হয়েছে। স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসনের সূচক নি¤œগামী হলেও কারও মনে দাগ কাটে না। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসনের সূচক নি¤œগামী হলে জনমনে উদ্বেগ বাড়ে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি) বৈশি^ক আইনের শাসন সূচক প্রতিবেদন ২০২১ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ বিশে^র ১৩৯টি দেশের মধ্যে ১২৪ তম অবস্থানে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে চতুর্থ পর্যায়ে রয়েছে। গেল বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চে প্রকাশিত সূচকে বাংলাদেশ ১২৮টি দেশের মধ্যে ১২২তম অবস্থানে ছিল। প্রত্যাশা ছিল সূচকের উন্নতি হবে। কিন্তু এবার ১২২তম থেকে ১২৪তম হয়েছে। অর্থাৎ দুই ধাপ অবনতি হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে অবনতির তকমা সরবে না। ডব্লিউজেপি সাতটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আইনের শাসনের সূচক তৈরি করে। যেমন ঃ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতার প্রয়োগ, ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচার পাওয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, দুর্নীতির অবস্থান, জননিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং সরকারি তথ্য প্রকাশের মাত্রা। এর কোনোটিতেই বাংলাদেশের আশানুরূপ অগ্রগতি দেখা যায়নি।  বৈশ্বিক পরিসরেই কেবল বাংলাদেশ আইনের শাসনে পিছিয়ে তা কিন্তু নয়! আঞ্চলিক পরিসরেও বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক। খারাপের অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের পরেই উগান্ডা, হন্ডুরাস, জিম্বাবুয়ে ও মিয়ানমার রয়েছে। আইনের শাসন সূচকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ডেনমার্ক, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড। অপরদিকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে কঙ্গো, কম্বোডিয়া ও ভেনেজুয়েলায়। 

একটা বিল্ডিং ভেঙ্গে গেলে সেখানে আবার নতুন বিল্ডিং তৈরি করা যায়। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক দেশে আইনের শাসনের ব্যত্যয় ঘটলে সেখানে আইনের শাসন ফিরিয়ে আনা যায় না। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও তার প্রতিফলন একেবারে নগণ্য। আইনের শাসনে ন্যায়বিচারের জন্য যে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা থাকার কথা, তা অনেকটা কাজির গরু কেতাবে আছে, বাস্তবে নেই। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদলেও শাসকগোষ্ঠী আয়নায় নিজেদের মুখ দেখার চেয়ে অতীতে কে কত খারাপ করেছে, সেই কাসুন্দি ঘাঁটতে ব্যস্ত। সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ তৃতীয় মেয়াদের মাঝামাঝিতে এসে পড়েছে। অথচ আইনের শাসনের উন্নতি তো দূরের কথা, অবনতির সূচকটাও ধরে রাখতে পারেনি। কারণ যে দেশে দুর্নীতির চাষাবাদ হয়, সেদেশে দুর্নীতিরই প্রসার ঘটে। গত ১২ বছরের উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতি বেড়েছে। কিন্তু জবাবদিহি প্রায় শূন্যের কোঠায়। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণহীন প্রয়োগ ও দুর্নীতি দমনে সরকারের পক্ষপাতমূলক আচরণ সূচকের নিম্ন গামীতাকে উসকে দিচ্ছে। সরকার আইনের শাসন ও মানুষের অধিকারের কথা বললেও বাস্তবে আইনের শাসনের স্লোগানের পরিপন্থী ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির ও পূজামন্ডপের হামলার ন্যাক্কারজনক ঘটনা জনমনে উদ্বেগ বাড়ছে। 

কুমিল্লাতেই চারজন নিহত হয়েছে। যারা প্রকৃত অপরাধী তাদের শাস্তি হোক এবং মিথ্যা মামলার হয়রানি বন্ধ করা হোক।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা কত যে জরুরী সেটা ক্ষমতায় থাকলে অনুধাবন করা যায় না। কিন্তু বিরোধীদলে থাকলে টের পাওয়া যায় কত ধানে কত চাল। একটি দেশে যখন কেবল ক্ষমতায় টিকে থাকার রাজনীতির-ই চর্চা হয় তখন সেখানে আইনের শাসন ও মানবতাবোধ থাকে না। আইনের শাসনের স্লোগানের ছিটেফোটাও যদি কার্যকরী করা যেতো তাহলে আইনের শাসনের সূচক বার বার নিম্ন গামী হতো না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আইনের শাসনের সূচক নিম্মগামী হওয়া কেবল উদ্বেগজনক নয়, পীড়াদায়কও বটে। অর্থনৈতিক উন্নয়নই একটি দেশের শেষ কথা নয়। আইনের শাসন ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা যাদের দায়িত্ব তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক, এমনটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ